
সাইফুল হক মোল্লা দুলু //
আজ কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন, দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। আজীবন আপসহীন রাজনীতিক মো. জিল্লুর রহমান স্বাধীনতার মাস মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। আবার মার্চ মাসেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মো. জিল্লুর রহমান ছিলেন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার জীবন ও কর্ম এবং ত্যাগ অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা, দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে অসীম ধৈর্য ও প্রজ্ঞা তাকে যেমন মহান করেছে, তেমনি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাকে অনন্য প্রতীক করে রেখেছে। জিল্লুর রহমান ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতির একজন সক্রিয় যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের একজন বিশিষ্ট সংগঠক। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের যে ক’জন কীর্তিমান ছাত্রনেতা সে সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন ফজলুল হক হলে। ‘৫২ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফজলুল হক হলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ‘৫২-এর উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ছাত্রনেতা হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্ররা যখন বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তে অনমনীয়, তখন তারা প্রস্তুতি নিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক সভা করেন। তার সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে ১৯৫৩ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয় এবং স্বৈরাচারী সরকার তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরে আন্দোলনের মুখে ওই সরকার তার ডিগ্রি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
তার পিতা মেহের আলী ছিলেন ময়মনসিংহের একজন বিশিষ্ট আইনবিদ। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। জিল্লুর রহমান ভৈরবের কেবি হাই স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিক, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এমএ এবং পরে এলএলবি ডিগ্রি নেন।
১৯৫৪ সালে যখন তৎকালীন পূর্ববাংলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন জিল্লুর রহমান বৃহত্তর ময়মনসিংহের যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয় তাকে। পরে তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান নির্বাচিত হন এবং তাকে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। জিল্লুর রহমান প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালে সারা পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন হয়। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকারের পরিচালিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ পরিচালনা ও ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলসহ ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান এবং সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দলের সভাপতি। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ চার বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্ত হয়ে দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দলের হাল ধরেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালে দলীয় কাউন্সিলে তিনি পর পর দু’বার দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তিনি এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। একই সঙ্গে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতার দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারির পর ওই বছরের ১৬ জুলাই রাতে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে দল পরিচালনা করেন। তখন তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
আইভি রহমান স্ত্রী হিসেবে ছিলেন তার জীবন ও রাজপথের সঙ্গী। আইভি রহমান মহিলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় জিল্লুর রহমান তার জীবনসঙ্গী ও আদর্শের সাথি আইভি রহমানকে হারান। জীবনসঙ্গীকে হারানোর অপূরণীয় ক্ষতির পরও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের হাল ধরতে সক্ষম হন। তার ছেলে নাজমুল হাসান পাপন ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। দেশপ্রেমিক ও জনকল্যাণকামী জননেতা হিসেবে জিল্লুর রহমান দীর্ঘকাল ভাস্বর থাকবেন। গভীর শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি।
সাংবাদিক
dulu1963@gmail.com