
সুব্রত বিশ্বাস//
স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন-বাঁধন “একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন” এই শ্লোগানকে বুকে ধারণ করে ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ‘‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন” এই শ্লোগানকে ধারণ করে যে সব শিক্ষার্থীগণ স্বেচ্ছায় রক্তদানকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করে সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে তা সত্যিই অনস্বীকার্য। একজন মুমূর্ষু ও মৃত্যু পথযাত্রীর বেঁচে থাকার স্বপ্ন লালন করার প্রয়াসে এগিয়ে আসছে নির্ভীক তারুণ্যের প্রতীক বাঁধন কর্মীরা, তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছে “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।” বাঁধন একটি অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক ও স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন।
বর্তমানে দেশের ৫৩ জেলার ৭৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কার্যক্রম শুরু থেকে নিজেরা স্বেচ্ছায় রক্তদান, বিনামূল্যে রক্তের গ্রæপ নির্ণয় এবং স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করে চলেছে । অদ্যবধি বাঁধন প্রায় ২১ লক্ষ মানুষের বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেছে এবং প্রায় ১০ লক্ষ ব্যাগ বিশুদ্ধ রক্ত সরবরাহ করেছে।
রক্ত মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পূর্ণমাত্রায় রক্ত থাকলে মানব দেহ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া দেখা দিলেই শরীর অকেজো ও দুর্বল হয়ে প্রাণশক্তিতে ভাটা পড়ে। আর এই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটি কারখানায় তৈরি হয় না । বিজ্ঞানীদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্তেও এখনও রক্তের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি, নিকট ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে এমনটাও আসা করা যায় না। মানুষের রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়, জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার রক্তই লাল। এর মধ্যে কোন বিভেদ নেই । মানুষের শরীরে রক্তের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি যে, রক্ত ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে প্রায়ই জরুরী রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়। যেমন- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, রক্তবমি বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে, দুর্ঘটনায় আহত রোগী, আস্ত্রোপচারের রোগী, সন্তান প্রসবকালে, ক্যান্সার বা অন্যান্য জটিল রোগ, এনিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার ইত্যাদি রোগের কারণে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া বর্তমানে অঙ্গ প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে, যা সফল করতে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। ১৮ থেকে ৬০ বছরের যে কোন সুস্থ ব্যক্তি যাদের শরীরের ওজন ৪৫ কেজির উপরে, তারা প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর নিয়মিত রক্তদান করতে পারেন। একজন সুস্থ মানুষের শরীরে পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে। এর মধ্যে সাধারণত ২৫০ থেকে ৪৫০ মিলিলিটার রক্তদান করা হয়, যা শরীরে থাকা মোট রক্তের ১০ ভাগের ১ ভাগ। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দান করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এই ঘাটতি পূরণ করে। আর প্রকৃতিক নিময়েই যেহেতু প্রতি ৪ মাস পর পর আমাদের শরীরের রেড সেল বদলায়, তাই বছরে ৩ বার রক্ত দিলে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না বরং শরীরের লোহিত রক্তকণিকাগুলোর প্রাণ ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। একব্যাগ রক্ত দিয়ে শুধু একটি নয় বরং ক্ষেত্র বিশেষে তিনটি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। কেননা এক ব্যাগ রক্তকে এর উপাদান হিসেবে তিন ভাগে ভাগ করে তিনজনের দেহে সঞ্চালন করা সম্ভব। উপাদানগুলো হলো- Red Blood Cell, Platelet & Plasma or Cryoprecipitate. এক একজনের জন্য এক একটি উপাদান প্রয়োজন হয়। তাই আপনার এক ব্যাগ রক্ত এক সঙ্গে বাঁচাতে পারে তিনটি প্রাণ। সামান্য পরিমাণ রক্তদানের মাধ্যমে একটি জীবন বাঁচানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ। নিয়মিত রক্তদান করা একটি ভাল অভ্যাস। রক্তদান করা কোন দুঃসাহসিক বা অসম্ভব কাজ নয়, বরং এর জন্য একটি সুন্দর মন থাকাই যথেষ্ট। রক্তদানে শরীরের কোন ক্ষতি হয়ই না বরং নিয়মিত রক্তদান করলে বেশকিছু উপকারও পাওয়া যায়। যেমন-
– একবার ভাবুন আপনার এক ব্যাগ রক্তদানে একসংগে তিনজন মানুষের জীবন বেঁচে উঠছে। সে মুহূর্থে আপনার যে মানবিক তৃপ্তি তাকে কখনোই অন্য কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়।
– রক্তদাতা রক্তদান করলে জানতে পারেন তিনি কোন সংক্রামক রোগে ভুগছেন কি-না।
– নিয়মিত রক্তদান করলে রক্তদাতার হার্ট ভাল থাকে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
-নিয়মিত রক্তদানে রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়। ফলে রক্তদাতার হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ দিন ঝুঁকি কমে যায়।
-নিয়মিত রক্তদানে রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়। ফলে রক্তদাতার হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির ঝুঁকি কমে যায়।
– রক্তদানের মাধ্যমে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ বাড়ে।
-শরীরে রক্তকণিকা তৈরির কারখানা হলো অস্থিমজ্জা। নিয়মিত রক্তদান করলে অস্থিমজ্জা থেকে নতুন কণিকা তৈরির চাপ থাকে। ফলে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। এতে যে কোন দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলেও শরীর খুব সহজেই তা পূরণ করতে পারে।
-স্বেচ্ছায় রক্তদাতাকে একটি ডোনার কার্ড দেয়া হয়। ওই কার্ড দিয়ে রক্তদাতা নিজে এবং নিজের পরিবার প্রয়োজনে আজীবন ওই প্রতিষ্ঠান থেকে রক্ত পেতে পারেন।
-রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত
১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা বাঁধন ২০২২ সালে গৌরবময় ২৫ বছর পূর্ণ করছে। বাঁধন-এর এই ২৫ বছরের পথচলাকে স্মরণীয় করে রাখতে নিয়মিত কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজের সমন্বয়ে রজতজয়ন্তী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ সারাদেশব্যপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, দুঃস্থ জনগণের জন্য বিনামূল্যে মেডিক্যাল ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা প্রদান, ৬৪ জেলায় বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ইত্যাদ।
রক্তদান আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে। এটা সম্পূর্ণ মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক কার্যক্রম। এর মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে, এমনকি ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সুতরাং আসুন, আমরা প্রত্যেকে হয়ে উঠি একেকজন রক্তযোদ্ধা এবং উৎসাহিত করি স্বেচ্ছায় রক্তদানে ।
সমন্বয়ক-মিডিয়া সেল টু ভাইস চ্যান্সেলর এবং কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।