
সিএনবাংলাদেশ ডেস্ক:
অযোধ্যার রাস্তায় পুলিশের টহল। ছবি।পিটিআই। দীর্ঘ বিতর্কের পর শনিবার অযোধ্যার বাবরি মসজিদ মামলার রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। মসজিদের বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমিতে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেন আদালত। একই সঙ্গে মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণের জন্য শহরের ‘উপযুক্ত’ স্থানে পাঁচ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ঐতিহাসিক ওই রায়ের মধ্যে দিয়েই শেষ হলো দীর্ঘদিনের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি। গতকাল সর্বসম্মত রায় প্রদান করেছেন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার‘র প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ ধরপাকড় শুরু হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। গতকাল রায় ঘোষণার পর থেকে মোট ১২টি এফআইআরে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ পুলিশ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ওই মামলা সম্পর্কিত ৩ হাজার ৭১২টি পোস্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কিছু পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে। বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে অনেক অ্যাকাউন্ট।
কোনো গুজব যাতে না ছড়ায়, তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজ্যবাসীর তৎপরতার ওপরও নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজিপি ওপি সিংহ। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন পড়লে রাজ্যের সর্বত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসানো হবে, যাতে গুজব ছড়িয়ে কেউ অশান্তিতে ইন্ধন জোগাতে না পারে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে লখনৌতে। সেখানে বসেই অযোধ্যাসহ গোটা রাজ্যের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্মকর্তারা। ব্যক্তিগতভাবে সবকিছুর তদারকি করছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এ ছাড়া খোলা হয়েছে জরুরি সেন্টার, যাতে কোথাও সমস্যার খবর পেলেই তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এসবের মাধ্যমে পুরো রাজ্যের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
ঘটনাক্রম
*১৫২৮ সালে অযোধ্যায় তৈরি হয় এই বাবরি মসজিদ। হিন্দু সংগঠনের দাবি, একটি মন্দির ধ্বংস করে তার জায়গায় মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে। ১৮৫৩ সালে প্রথমবার এই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়। ১৮৫৯ সালে ইংরেজ প্রশাসন ওই জায়গাটিতে হিন্দু এবং মুসলিমদের প্রার্থনা জন্য ফেন্স লাগিয়ে দেয়, প্রায় ৯০ বছর ধরে এটি ছিল। ১৯৪৯ সালে প্রথমবার জায়গাটিকে নিয়ে মামলা হয় মসজিদের পাশে ভগবান রামচন্দ্রের মূর্তি লাগানোর পর।
*১৯৮৪ সালে রামমন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি তৈরি করে হিন্দু সংগঠন। পাঁচ দশক পর মসজিদের গেট খোলার নির্দেশ দেয় জেলা আদালত, এবং ‘বিতর্কিত নির্মাণের’ পাশে হিন্দুদের প্রার্থনার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে মন্দির নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ‘বিতর্কিত নির্মাণ’ সংলগ্ন জায়গায়।
*১৯৯০ সালে তৎকালীন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবানি ওই জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য সমর্থন চেয়ে দেশজুড়ে রথযাত্রা বের করেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার অভিযোগ ওঠে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিরুদ্ধে।
*১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের বিশ্বাস, ভগবান রামচন্দ্রের জম্মভূমিতে তৈরি করা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে উপর মসজিদ করা হয়েছে। এ মসজিদটি ভেঙে ফেলার পর সৃষ্ট হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়।
*বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ১০ দিন পর লিবারহেন কমিশন তৈরি করা হয় ঘটনার তদন্তে। ২০০৯-এ কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে নাম ছিল একে আডবানি, অটলবিহারী বাজপেয়ি এবং অন্যান্য বিজেপি নেতাদের, প্রায় ১৭ বছর পর শুরু হয় তদন্ত।
*২০০২ সালের এপ্রিলে এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ, কার হাতে জায়গাটি থাকবে সেই মামলার শুনানি শুরু করে। ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে রায়দান করে এলাবাহাদ হাইকোর্ট। সেখানে বলা হয়, বাবরি মসজিদকে তিনভাগে ভাগ করা হবে, একটি যাবে নির্মোহি আখরা, একটি রামলালা এবং অপরটি থাকবে উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের। এক মাসের মধ্যে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় হিন্দু ও মুসলিম সংগঠন।
*২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি আদালত জানায় যে, সাতজন হিন্দু নেতা, তার মধ্যে কয়েকজন বিজেপি নেতাকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে জন্য বিচার বিভাগের সামনে আসতে হবে। তবে তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী আডবানির বিরুদ্ধে কোনো চার্জ আনা হয়নি। এক বছর পর উত্তরপ্রদেশের একটি আদালত জানায়, আদালতের দেওয়া ছাড় পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
বিজেপি নেতা মুরলি মনোহর জোশী এবং উমা ভারতী বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু করে লখনৌ আদালত। জুন মাসে মামলার শুনানি করা বিচারকদের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। রায়দানের জন্য ৯ মাসের সময়সীমা দেওয়া হয়।
*২০১১ এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বেশীদিন নয়, শীর্ষ আদালত জানায়, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় আশ্চর্যজনক। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত তিন সদস্যের দল মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হওয়ার পর ৬ অগস্ট দৈনিক শুনানি শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ। ৪০ দিন শুনানির পর ১৬ অগস্ট দৈনিক শুনানি শেষ হয়।
রায়কে ঘিরে গত ২০ অক্টোবর থেকে অযোধ্যা শহরে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ১০ নভেম্বর থেকে এই শহরে জারি হচ্ছে কারফিউ। এই সান্ধ্য আইন অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষণার পর চার দিন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অযোধ্যার নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে ৪০ কোম্পানি আধা সেনা। উত্তর প্রদেশের ধর্মীয় জায়গাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।